Blog
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – নৈর্ব্যক্তিক উত্তর
সাদেক আহমদ চৌধূরী (সাদী), লন্ডন, যুক্তরাজ্য
প্রতি
সুতপা সেনগুপ্ত,
অধ্যাপক ও কবি
মহাশয়া,
সম্প্রতি ফেসবুকে আপনার একটি মন্তব্য পড়ে যারপরনাই লজ্জিত হয়েছি। সেখানে আপনি স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পর্কে লিখেছেন- ‘এক অসহায় মহিলাকে তিনি সহায়তা দিয়েছিলেন, পরে তার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি সম্পর্ক ঘটে যায় ও এক সন্তান হয়’ । আপনি প্রাজ্ঞজন ও বাংলাভাষার বিশিষ্ট কবি। সেই সুত্র ধরে বলি, আধুনিক বাংলাভাষার বর্ণমালা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দান ; ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে এটাও প্রতিষ্ঠিত যে, পিছিয়ে পড়া ও অসহায় নারীর সামাজিক মানোন্নয়নের জন্য তিনি জীবনভর লড়াই করেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, যৌনতা একটি ব্যক্তিগত বিষয় এবং প্রেমজ যৌনতা বা সম্মতিসাপেক্ষে যৌনতা কখনই কোন প্রকার প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে না। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যটির কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে বলে মনে হয় না।
বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনি বিশিষ্ট এক কেচ্ছাকবিকে, হয়তো, আড়াল করতে গিয়ে এরূপ মন্তব্য করেছেন। উক্ত অধ্যাপক কবির জন্য সম্প্রতি ঐতিহ্যবাহী একটি পত্রিকার সঙ্গে বাংলাভাষা সাহিত্যে যুক্ত অনেকেই ব্যথিত ও লজ্জিত হয়েছেন। একজন জীবিত ও সাধারণ কবিকে বাঁচাতে আধুনিক বাংলাভাষার অন্যতম রূপকারকে অসম্মান করার অধিকার আপনার নেই।
পরিশেষে বলি, আপনি আধুনিক বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পিতৃপুরুষের সঙ্গে সঙ্গে সুমহান ঐতিহ্যকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছেন। তাই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কিত কু-মন্তব্যের সাপেক্ষে এই ফেসবুকে প্রমাণ দাখিল করার জন্য আপনাকে সাতদিন সময় দেওয়া হলো, অন্যথায় আপনার অপারগতা বৃহত্তর আন্দোলনের পথ সুপ্রশস্ত করবে।
ধন্যবাদান্তে,
প্রসূন প্রামাণিক
শুভদীপ সেনশর্মা
মৌমিতা পাল
মনোজ দে
অনিমেষ মণ্ডল
প্রদীপ চক্রবর্তী
রাহুল বিদ
বিশ্বরূপ বিশ্বাস
জুবিন ঘোষ
অনুপম মুখোপাধ্যায়
সুকুমার মণ্ডল
শৈলেন চৌনী
সৌমাল্য গরাই
শুভদীপ আইচ
রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌরভ চন্দ্র
প্রবীর মজুমদার
প্রতাপ মুখোপাধ্যায়
সঞ্জয় সাহা
সুভাষ মিশ্র
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
রত্না রশীদ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশ দাস
কুন্তল মন্ডল
সৌমাল্য গড়াই
প্রসেনজিৎ গুপ্ত
প্রতাপ মুখোপাধ্যায়
অনুব্রতা গুপ্ত
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল
শ্রাবনী এন্দ চৌধুরী।
শামীম আজাদ
খাদিজা হালিম রাহমান
সাদেক আহমদ চোধুরী (সাদী)
==================================================
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – নৈর্ব্যক্তিক উত্তর
সাদেক আহমদ চৌধূরী (সাদী), লন্ডন, যুক্তরাজ্য
বিষয়টিকে আমি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখতে চাই। কেন এই অধ্যাপক এবং কবি এরূপ একটি বক্তব্য দিয়েছেন? এর পিছনে কারণ কী?
ধরে নিলাম, সত্যি সত্যি ঈশ্বরচন্দ্রের এরূপ একটি সম্পর্ক ছিলো। তাতে কী প্রমাণ হয়? তাতে কি প্রমাণ হয় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলন মিথ্যা, নারী শিক্ষা প্রচলন মিথ্যা, সমাজ সংস্কার মিথ্যা, মানুষকে তিনি সহায় করতেন – এটা মিথ্যা…?
দক্ষিন এশিয়া মহাদেশের মানুষেরা অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। এখানে একটা সাধারণ চিত্র দেখা যায় যে, একজন গুণী ব্যক্তিকে বা পছন্দের ব্যক্তিকে আমরা মানুষ থকে দেবতায় পরিণত করে ফেলি। ঠিক তেমনি একজন অপছন্দের মানুষকে দানবে পরিণত করি। এটা এতটাই ব্যাপক রূপ নিয়েছে যে, সর্বক্ষেত্রেই এর প্রচলন দেখা যায়। যে কারণে সিনেমাতে দেখা যায় নায়ক সর্বক্ষেত্রেই প্রথম – লেখাপড়ায় প্রথম, খেলাধুলায় প্রথম, মানবতার দিক থেকে প্রথম, গানও করে সবচেয়ে ভালো আর দেখতেও সবচেয়ে সুন্দর আর ভিলেন সব দিক থেকেই অধম। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক চিন্তাশীল বা শিক্ষিত ব্যক্তিও এই “Hegemony Bubble” থেকে বের হতে পারে না। এবং এর সাথে যুক্ত হয় “Halo Effect” এবং “Horn Effect”. যে কারণে “একজন ভালো মানুষের কোনই খারাপ দিক থাকতে পারে না” বা “একজন খারাপ মানুষের কোনই ভালো গুণ থাকতে পারে না”। পাশ্চাত্য দেশে বেশিরভাগ সময়েই এই বিষয়টিকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে দেখার চেষ্টা করা হয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। যেমন আব্রাহাম লিংকন, থেচার বা চার্চিল থেকে শুরু করে মোৎসার্ট এদের সম্পর্কে গুণ এবং দোষ দুটোই বলা হয়। কাউকেই দেবতা রূপে দেখানো হয় না। কিন্তু এই চিন্তা দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের মানুষেরা করতে অভ্যস্ত নয়। আমাদের কোনো রাষ্ট্রনেতা বা পছন্দের ব্যক্তি সম্প্রর্কে তাদের দুর্বল বৈশিষ্ট্য বলা যায় না।
এখন উক্ত অধ্যাপক এবং কবি যদি ঈশ্বরচন্দ্রকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার করে, তার লেখাকে একটি তথ্য আকারে প্রদান করেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। এই তথ্যের জন্য ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি আমার শ্রদ্ধা তো কমবেই না বরং বাড়বে। কারণ এতে ঈশ্বরচন্দ্রকে দেবতার বদলে মানুষ রূপে দেখতে পাব। আর এটাই হচ্ছে চিন্তার জগতে রেনেসাঁ – যা এখনো বেশিরভাগ মানুষ অর্জন করতে পারিনি।
কিন্তু এই কবির লেখার মধ্যে অন্য একটি দিক আছে। ভারতবর্ষে বর্তমানে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের উত্থান হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দু দেশাচার বিরোধী অনেক কাজ করেন এবং ইংরেজরা তাকে সহায়তা দান করেন। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের একটা অংশএই দেশাচারকে হয়ত ফিরিয়ে আনতে চান যে কারণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে হিন্দুত্ববাদী বিরোধী হিসেবে দেখছেন। ঈশ্বরচন্দ্র হিন্দু শাস্ত্রকে ঠিক রেখে হিন্দু সমাজ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের একটা অংশ যদি সেই সমাজকে আবার চালু করতে চান তবে ঈশ্বরকে বিতর্কিত করতে হবে। যদি একবার এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরে, মানুষ তখন ইশ্বরচন্দ্রকে একেবারে দেবতা থেকে দানবে পরিণত করবে (যেহেতু এটাই এই উপমহাদেশের মানুষের বৈশিষ্ট্য)। তাহলে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের “প্রাচীন কালের হিন্দু দেশাচার ” প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পুর্ণ হবে।
যেহেতু আমি এই অধ্যাপক কবির উদ্দেশ্য জানি না তাই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবে যেহেতু এখনো এই উপমহাদেশের মানুষেরা এমন কি বেশিরভাগ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও “Hegemony”, “Halo Effect”, এবং “Horn Effect” থেকে বের হয়ে মুক্ত চিন্তা করতে অভ্যস্ত নয়, তাই ঈশ্বরচন্দ্রকে কেউ যেন দানবে পরিণত করতে না পারে – সেই জন্যেই আমি মনে করি এরূপ এক ব্যক্তিকে রক্ষা করা আমার দ্বায়িত্ব।